Category Archives: সাহিত্য

একটি নিরালোক সংস্কার

অনন্যা মান্না

সময় নির্ধারিত শব্দে ছিনিয়ে নেয় অনাড়ম্বর প্রয়াগ।

দুয়ারে অবনত বসন্ত, 

কনকাঞ্জলি হয় জারজ অভিজ্ঞানে।

অথৈ সন্ধির পর একটি শুষ্ক বিরান কথাসাহিত্য!

অংসল ক্ষতে ইন্ধন দেয় এক একটি শীতের গান্ধর্ব,

কিভাবে যেন ধীয় জ্ঞানে নিয়মিত হয়ে আসে হাঁড়ি কড়াইয়ের কলহ,

মায়া হয়,অন্ধকার ঘরের গোপনাঙ্গ মনে করে।

কিভাবে সূর্যালোক অধিগ্ৰহণ করার পর থেকে সেজে ওঠে ঘর,অভিশপ্ত হয়ে যায় সেই থেকে।

শিশির আজমের দু’টি কবিতা

স্টিল লাইফ উইথ ইভনিং টেবল

🌿

পা দুটো স্বাধীন না আমি স্বাধীন, এ প্রশ্ন অবান্তর। গত সন্ধ্যায়

আমার টেবিলে দুটো প্রজাপতি এসেছিল,

মুখ দেখে মনে হলো সাইবেরিয়ান– না কি মিশরীয়,

দুই রাজকুমারী?

কিন্তু আমার বইগুলোর দিকে ওরা অমন বিশ্রীভাবে তাকাচ্ছিল কেন?

বইয়ের কি পা আছে?

দেখছিলাম প্রজাপতির ডানাগুলোকে আর ডানার আদিগন্ত সন্দেহজনক

বাঁকগুলোকে।

যা হোক আমার উচিৎ ছিল উৎকন্ঠিত না হয়ে

ওদের অভ্রধর্মীয় পাগুলোকে যথার্থভাবে পর্যবেক্ষণ করা

গোড়ালির অনতিদূর উপজাতীয় বনে কারা নিঃশঙ্ক ঘুরে বেড়ায়

তা দেখা।

যখন ওরা ঘুমোয়, ওদের পাগুলোকে ওরা রাখে কোথায়

এ তো আমাদের জানা দরকার।

মালকোশ

🌿

নিখিল ব্যানার্জী শুনতে শুনতে মনে হলো

আমাকে তুমি ডাকছো!

অথচ তুমি অনেক দূরে আর তেরো বছর তোমার সঙ্গে

আমার দেখা নেই।

তেরো বছর কোথাও আমি চিঠি লিখিনি।

এখন রাত দেড়টা।

নিখিল ব্যানার্জীর সঙ্গে তোমার কি দেখা হয়?

মৃত্যুভয়

মতিলাল দাস 

মৃত্যু মানে একটা অন্ধকার ঘর, যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না।

দরজার ওপারে কেমন জানি সুর বাজে, শুনি অথচ বুঝি না।

আমি বেঁচে থাকি নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে, কিন্তু মৃত্যুভয় আমার শোবার পাশে বসে।

রাত হলে ওর পা টের পাই, বিছানার নিচে, খুব ধীরে ঘোরে।

জানালা খুললে আলো আসে, 

কিন্তু মনে হয় ওর চোখও তাকিয়ে আছে।

মাথার ভেতর একেকদিন কুয়াশা জমে যায়,

জীবন আর মৃত্যু, দুই বন্ধু যেন, লুকোচুরি খেলছে।

জন্মদিনে কেক কাটার শব্দে কাঁটা হয়ে যায় বুক।

কেউ বলে—মৃত্যু শান্তি, কেউ বলে শূন্যতা,

আমি শুধু দেখি কাঁপা কাঁপা পায়ে একটা ছায়া হেঁটে যায়।

এই শহরের ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকা মুখগুলোও জানে,

আজকেও কেউ না কেউ হারিয়ে যাবে,

চুপিচুপি, একটুও শব্দ না করে।

আমি আয়নায় তাকিয়ে থাকি, 

দেখি চোখের কোণে এক অচেনা ক্লান্তি।

জীবন চিৎকার করে বাঁচতে চায়, অথচ

মৃত্যুভয় কানে ফিসফিস করে—

“আমি খুব নরম পায়ে আসবো, প্রস্তুত হও।”

তারপর ঘুম ভেঙে দেখি, আমার ছায়াটাও কাঁপছে।

যে ভাষা মায়ের ছিল

শুভজিৎ দত্তগুপ্ত

নবগ্রাম স্টেশন থেকে পঞ্চাশ মিনিট হাঁটলেই এক গ্রাম—বোরোডাঙা। এখন লোকজন চেনে না খুব একটা, কারও কারও কাছে পরিচিত “ওই ক্যানেলের পাড়ের পাড়া” নামে। কিন্তু এক সময় এই পাড়াতেই ছিল বাউলতলা, চড়কমঞ্চ, শখের যাত্রাদল আর জলখেলা-ভাটিয়ালির রেওয়াজ।

সেই পাড়ারই এক মাটির দালানবাড়িতে থাকতেন সুবর্ণা রায়—সবার মুখে “সুবোদি”।

গায়ের গা-লাগা এক অদ্ভুত সুরে কথা বলতেন তিনি, যেটা একদিকে পুরনো রাঢ়বঙ্গীয় উপভাষার ছোঁয়া, অন্যদিকে ব্যক্তিগত আবেগ ও অভ্যাসে গড়া নিজস্ব কণ্ঠসংস্কৃতি। সে ভাষায় ‘পিঠে’ হয় ‘ফিটা’, ‘ছেলে’ হয় ‘ভোবা’, ‘ভাত’ হয় ‘ভোত’—আর এই ভাষায় মা ডাকে যেমন, বকেও তেমন।

তাঁর ছেলে অভিমন্যুর ডাকনাম ছিল সেই টানেই—ভোবা।

সুবর্ণার মুখে এই ভাষাই ছিল ভালোবাসার কণ্ঠস্বর। তিনি বলতেন,

“ভোবা আয় রে, গরুর গোয়াল থেকে দুধ আনবি, মা ভাত গরম করে রাখছি।”

অভিমন্যু বড় হতে হতে শহরের স্কুলে ভর্তি হল। সেখানে শিক্ষক বলতেন, “শুদ্ধ বাংলা চর্চা করো, গ্রাম্য টান বাদ দাও।”

একদিন স্কুল থেকে ফিরে ছেলে মাকে বলল, “তুমি এমনভাবে বলো না তো মা, সবাই হাসাহাসি করে।”

সুবর্ণা মুচকি হেসে বলেছিলেন, “তুই যেমন আমাকে ডাকিস, সেই ডাকটাই তো আমি তোকে দিয়েছিলাম রে। এখন তুই ভুলে গেলি, আমি তো পারলাম না।”

তবে অভিমন্যু ভুলে গেল। উচ্চশিক্ষা, বড় চাকরি, মহানগর—সব মিলিয়ে তার ভাষা পাল্টে গেল, তার টান পাল্টে গেল, এমনকি তার নামও—অভিমন্যু হয়ে উঠল ‘অভি’।

সুবর্ণা থেকে গেলেন গ্রামে—পুরনো পাটকাঠির বিছানায়, খুপরি জানালার ধারে, যেখানে শিউলি গাছ থেকে রোজ ঝরে পড়ত সকালের সাদা রোদ।

দিন গড়াল। বছর পেরোল। ছেলের ব্যাঙ্গালোরে চাকরি, বিয়েশাদি, সংসার। মায়ের সঙ্গে ফোনে বাংলা নয়, ইংরেজি বা ‘নির্জীব শহুরে কথা’।

কিন্তু সুবর্ণা কথা বলে যেতেন নিজের ভাষায়। কারও সঙ্গে না হোক, নিজের সঙ্গেই—এক খাতা ভরে উঠত তাঁর লেখায়—

“ভোবা, তুই ফিরে আসবি তো? এই মাটির গন্ধ তোকে ডাকবেই—ফিটায় রোদ পড়েছে, গোয়ালে গরু দুধে ভেসে গেছে…”

যখন অসুস্থ হলেন সুবর্ণা, তখনো ছেলে এল না। অফিসের চাপ, মেয়ের টেস্ট, ফ্লাইট পাওয়া যায়নি।

একদিন প্রাইমারি স্কুলের দিদিমণির হাতে একটি চিঠি দিয়ে বললেন, “ভোবার জন্য রেখে দেবেন। যদি একদিন আসে…”

পরদিন ভোরে সুবর্ণা চিরঘুমে চলে গেলেন।

মাসখানেক পরে অভিমন্যু এল। বাড়ির উঠোনে ফাটল, কাঁথার রোদ নেই, গন্ধ নেই।

পুরনো কাঠের আলমারিতে একটা মাটির হাঁড়ির ভিতর খুঁজে পেল সেই চিঠি—

মায়ের হাতের লেখা, মা-র ভাষায়—

“ভোবা, তুই এখন বড় হইছিস। তোর ভাষাও বড় হইছে।

আমি পুরনো হইয়া গেছি, তোকে আর ডাকি না।

তোর নাম নাকি এখন অভিমন্যু বাবু।

কিন্তু আমি তোকে ‘ভোবা’ বলেই ডাকব যতদিন থাকি।

যেদিন আর থাকব না, তখন তোকে আর কেউ এই ভাষায় ডাকবে না।

ভাষা ফুরায়, মানুষ যায়—

কিন্তু মনে রইয়া যায় সেই ডাক,

যেটা কেবল মায়ের মুখেই ছিল।”

চিঠিটা পড়তে পড়তে অভিমন্যুর বুক ভেঙে এল।

কতদিন কেউ তাকে “ভোবা” বলে ডাকে না। এখন সে শুধু “স্যার”, “বাবা”, “বস”, “ড্যাড”…

আজ অভিমন্যু একটি গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুলেছে বর্ধমানেই—নাম দিয়েছে “ভোবার ভাষা”।

সেখানে সংগ্রহ হয় বাংলার বিভিন্ন মায়েদের মুখে মুখে থাকা হারিয়ে-যাওয়া উপভাষা, লোকবলির টান, পাড়ার ডাকনাম, এবং সেই পুরনো ছায়া—যেটা বইয়ে নেই, অভিধানে নেই, শুধু হৃদয়ের মাটিতে লেখা।

অভিমন্যু বলে—

“ভাষা শুধু যোগাযোগ নয়, ভাষা হল স্মৃতি।

যে ভাষা মায়ের ছিল, সেটাই পৃথিবীর প্রথম শব্দ।

সেই শব্দ যখন হারিয়ে যায়, একটা জাতি নিজের শিকড় হারায়।

আর আমি? আমি শুধু আমার মায়ের মুখের ভাষাটা ধরে রাখতে চাই—

কারণ ওটাই ছিল আমার পৃথিবী।”

বিশ্বাস

দেব মাইতি

আমি মায়ের অংক মেলাতে পারিনি
মাকে বললাম
শূন্যের আগে কিছু না কিছু সংখ্যা হয়
মা বুঝতে পারেনি

বাবা মানে যখন ঈশ্বর বুঝলাম
ততদিনে বাবা ঈশ্বর হয়ে গেছে

আর যতক্ষণে তুমি বুঝলাম
নদীতে শুশুক বিরল

আর বাচ্চারা ইতিহাস পড়ছে ভূগোল বিজ্ঞান
কোন স্ট্যাচুই তাদের সাথে কথা বলছে না

পৃথিবীটা ছোটো বড় রাক্ষসের মুখ বুঝতে না পেরে তারা খেলছে খেলছে আর খেলছে খেলতে খেলতে

ক্রমশ ভেতর দিকে ঢুকে যাচ্ছে

এই সেদিন যেমন স্কুল যাবার পথে লরির নিচে ডান হাত কাটা গেল বাচ্চা মেয়েটার

আমার একটা বিশ্বাস চাই, যে রকম বিশ্বাসে খালি হাতে বেরোনো মানুষ হাসি নিয়ে ফিরে আসে সংসারে

অ্যাশ ট্রে

নিসর্গ নির্যাস মাহাতো

ছোটবেলায় বাবার মুখে সিগারেটের গন্ধটা পছন্দ হত না। অগত্যা সময়ে সময়ে দূরে চলে যেতেন বাবা।

কতবার রাগে আছড়ে মেরেছি অ্যাশ ট্রে। ছড়িয়ে পড়ত সিগারেটের শেষ অস্থি গুলি।

সুদূর প্রবাসে নিঝুম রাতে আমার ছাইদানির দিকে তাকালে বুঝতে পারি, বাবা জমাতেন-

স্বপ্ন। দুশ্চিন্তা। হিসাব।

     আমার ভবিষ্যৎ।।

(ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক)

বোধের শিকড়

কাজী আজাদ

প্রতিটি স্বার্থপরতা
অন্ধবিশ্বাস
আর গোঁড়ামি
একটি বিন্দুতে গিয়ে শেষ হয়।
যেখানে মুছে যায়
সমস্ত আরোপিত বোধ,
সীমারেখা।
মুছে যায় “তুমি’ ‘আমি’।
জেগে থাকি আমরা
আর আমাদের পৃথিবী।